অ্যাডভোকেট মোঃ কামরুজ্জামান ভূঁইয়া,
আজকের জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘোষণার মতো। তিনি ঘোষণা করেছেন যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে—যেখানে জনগণ চারটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রস্তাবের বিষয়ে একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে মতামত জানাবেন। এই ঘোষণাটি শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন নয়, বরং বাংলাদেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের নতুন দিকনির্দেশনা বহন করছে।
রাজনৈতিক সংস্কারের পটভূমি: বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী নিরপেক্ষতা, সাংবিধানিক ভারসাম্য ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান। “জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫” মূলত সেই বিতর্কের সমাধান ও ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের কাঠামো পুনর্গঠনের রূপরেখা হিসেবে এসেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, সংসদীয় সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি—সবগুলো বিষয়ই এই সনদের অন্তর্ভুক্ত।
অধ্যাপক ইউনূসের ঘোষণা অনুযায়ী, সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট—একটি নির্বাচিত নিম্নকক্ষ এবং একটি আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে গঠিত উচ্চকক্ষ। উচ্চকক্ষের মাধ্যমে আইন প্রণয়নে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে এবং সংবিধান সংশোধনের জন্য উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হবে। এটি নিঃসন্দেহে এক সাহসী ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের সূচনা।
প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ: সংবিধানের ১১ ও ৭ ধারায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়েছে। গণভোট সেই সার্বভৌমত্বের বাস্তব রূপ। কিন্তু একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত প্রশাসনিকভাবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভোটারদের সচেতনতা, ব্যালটপেপারের জটিলতা, এবং ফলাফল ঘোষণার স্বচ্ছতা—সবকিছুই অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার দাবি রাখে।
তাছাড়া, গণভোটে যে প্রশ্নটি ব্যালটে থাকবে তা একটিমাত্র হলেও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত চারটি প্রস্তাবের ব্যাপকতা বিশাল। ভোটারদের জন্য বিষয়গুলো বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হতে পারে। তাই আইন মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশনের যৌথভাবে একটি বিস্তারিত নাগরিক সচেতনতা প্রচার অভিযান জরুরি।
সংস্কারের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা: “জুলাই সনদ”-এর মূল দর্শন হলো রাজনৈতিক ঐকমত্য ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করা। নতুন এই কাঠামোর মাধ্যমে ক্ষমতার একচ্ছত্রতা ভাঙা, নারী ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করা এবং স্থানীয় সরকারের ভূমিকা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণ এবং বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক দিক।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা আন্তরিক হবে? অতীতে আমরা বহু সংস্কার প্রস্তাব দেখেছি, যেগুলো কাগজে থাকলেও বাস্তবে রূপ নেয়নি। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য এবার সরকারের উচিত হবে আইনি কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াকে কঠোরভাবে অনুসরণ করা।
উপসংহার: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আজকের ভাষণ এক নতুন যুগের সূচনা ঘোষণা করেছে—একটি দায়িত্বশীল গণতন্ত্রের যুগ। তবে এই পরিবর্তন সফল করতে হলে শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা নয়, প্রয়োজন প্রশাসনিক দক্ষতা, আইনি স্বচ্ছতা, এবং জনগণের পূর্ণ অংশগ্রহণ।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ আজ এক মোড়ে দাঁড়িয়ে। এই সংস্কার যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এটি হতে পারে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নাগরিক আস্থার নতুন ভিত্তি। অন্যথায়, এটি কেবল আরেকটি অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় স্থান নেবে।
শেষ কথা: গণভোট মানে জনগণের কণ্ঠস্বরকে সরাসরি সংবিধানে প্রতিফলিত করা। তাই এই উদ্যোগে স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সাফল্য।
অ্যাডভোকেট মোঃ কামরুজ্জামান ভূঁইয়া
আইনজীবী, লেখক ও কলামিস্ট
দৈনিক মানবজীবন পত্রিকা।
Reporter Name 




















